দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি। বর্তমান স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে যখন দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো সেই আন্দোলনের সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন। এজন্য অবশ্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। দিনের পর দিন স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা পুলিশের রিমান্ডের নামে চরম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে এবং প্রায় পাঁচ বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
জন্ম : ১৯৮২ সালের ১৫ মার্চ এক রৌদ্রজ্জল সকালে মা তৈয়বা খাতুনের কোল আলো করে জন্ম নেন সময়ের সাহসী এই ছাত্রনেতা। তার পিতার নাম আব্দুল কাদের। তিনি ১৯৯৭ সালের ২৭মে ইন্তেকাল করেন। তার জন্মস্থান ঠাকুরগাঁও সদরের দানার হাটের সৈয়দপুর গ্রামে। জন্মের পর থেকে এই সৈয়দপুর গ্রামেই বেড়ে উঠেন দেলোয়ার হোসেন। গ্রামের ছেলে হওয়ায় দেলোয়ার হোসেনের চরিত্র যেনো এদেশের মাটি ও প্রকৃতির মতোই প্রতিবাদী।
শিক্ষাজীবন : দেলোয়ার হোসেন শালের হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার পর তিনি বালাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে তার উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা শুরু করেন। বিজ্ঞানের ছাত্র দেলোয়ার হোসেন কৃতিত্বের সাথে ২০০০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে ভর্তি হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক শেষ করার পর দেলোয়ার হোসেন ঢাকায় বাংলাদেশ ইসলামী ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন।
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন : পারিবারিকভাবেই দেলোয়ার হোসেনের সাংগঠনিক জীবনের যাত্রা শুরু হয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাবস্থায় তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী হন। তিনি ১৯৯৯ সালের ২৪ জুন সাথী শপত এবং ২০০২ সালের ১ অক্টোবর ছাত্রশিবিরের সদস্য শপথ গ্রহন করেন।
তার সাংগঠনিক দায়িত্ব শুরু হয় নিজ এলাকার শহীদ আব্দুল হামিদ উপশাখার সেক্রেটারির দায়িত্ব দিয়ে। পরবতীতে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের বায়তুলমাল ও সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সাথী হিসেবে যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী কাজলা এলাকার একটি ইউনিটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে কাজলা থানা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাজলা শাখার দায়িত্ব পালন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৪ সালে শহীদ শামসুজ্জোহা হল শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিক্ষা সম্পাদক, ২০০৬ সালের শুরুতে স্বল্প সময়ের জন্য কনটেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর পযন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭-০৮ ও ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে একই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক, ২০১১ সালে সেক্রেটারি জেনারেল এবং সবশেষ ২০১২-১৩ সেশনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আন্দোলন-সংগ্রাম : দেলোয়ার হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস, ছাত্রদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবী দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। দেশের শিক্ষানীতির পরিবর্তন, দেশবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে, গণমানুষের দাবি আদায়ের বিভিন্ন সংগ্রামে অংশগ্রহন ও নেতৃত্ব প্রদান করেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরব দাবীতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন অসম সাহসী এই ছাত্রনেতা। একই সাথে এই দেশে ইসলাম বিরোধী শাহবাগী নাস্তিক চক্র ও ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিচারিক হত্যার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন।
কারাজীবন : ২০১৩ সালে তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ভীত হয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। রিমান্ডের নামে পঞ্চাশেরও বেশি তাকে ডিবি অফিসে আটকে রেখে ইতিহাসের চরম নির্যাতনের মুখোমুখি করা হয়। শত নির্যাতনের মুখেও দেলোয়ার হোসেন ছিলেন অটল, অবিচল। মুমূর্ষু অবস্থায়ও তিনি তার আন্দোলন থেকে সরে আসতে রাজি হননি। দেশি-বিদেশি নানান চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করে নি কিন্তু কারাগারে আটকে রেখেছে প্রায় পাঁচ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দেলোয়ার হোসেন বঞ্চিত হয়েছেন তার মৌলিক অধিকারগুলো থেকে। স্বৈরাচারী সরকার তাকে কারাগারে আটকে রাখার জন্য প্রায় ১০৭ টি মামলা দিয়েছে। এই মামলার বোঝা এখনো তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে একই সাথে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে শত নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন।
পারিবারিক জীবন : ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দেলোয়ার হোসেন বগুড়া জেলার আব্দুল মান্নানের ২য় কন্যা মারজিয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক সন্তানের জনক। তার ছেলের নাম মাহমুদ।
পেশা : দেলোয়ার হোসেন একজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী।
রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন : ছাত্রশিবিরের সভাপতি থেকে বিদায় নেয়ার পর ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি কারাগারে থাকা অবস্থায় দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয়ভাবে প্রবেশ করেন। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন। একইসাথে তিনি কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। দুস্থ ও গরিব মানুষদের সহায়তা ও গরিব মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের বৃত্তি ও বিভিন্ন সহায়তা তার নিয়মিত কাজের অংশ। তার নিজ এলাকায় ‘ঠাকুরগাঁও ছাত্রকল্যাণ ফোরাম’সহ বিভিন্ন ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্ট্রের সাথেও তিনি জড়িত থেকে নিয়মিত এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই দেলোয়ার হোসেন একজন ক্রীড়ামোদী ব্যক্তিত্ব। বর্তমান সময়ে তিনি কয়েকটি ক্রিড়া সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে যাচ্ছেন।